সেরা ভালোবাসার গল্প (কালো ছেলে-পর্ব -১)

বর্ষার পড়ন্ত বিকেল। বেশ কিছুক্ষণ টানা বৃষ্টি হওয়ার পর আকাশ পরিষ্কার। পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়া সূর্যের লালিমা আভায় সেজেছে পরিবেশ। আস্তে আস্তে নিঃস্তেজ হয়ে আসছে সেই লালিমা আলো। আকাশের বুকে পাখিরা উড়াল দিয়েছে নীড়ের উদ্দেশ্যে।

গ্রামের আঁলপথ ধরে বাড়ি ফিরছে শ্রুতি। আর তার ছোট চাচার মেয়ে। অর্থাৎ তার চাচাতো বোন শেফালী। দুজনেই খুব তাড়া দিয়ে হাঁটছে। 

হঠাৎ শেফালী কাদামাখা আঁলে পিছলে পরে গেলো। শ্রুতি বললো, এতদিন হলো এই মেঠোপথে হাঁটিস! আর এখনো পিছলে পরে যাস! ইচ্ছে করে পরেছি নাকি? এই জুতোর জন্যেই তো পরলাম।"

হইছে আর কৈফিয়ত দিতে হবে না! এবার চল তাড়াতাড়ি। নাহলে মা কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে! সত্যি কথা বল না আপা! যে, তুই তোর কালাচাঁদকে দেখার জন্য হাঁসফাঁস করছিস।

সেরা ভালোবাসার গল্প

শেফালীর কথা শুনে শ্রুতির মন খারাপ হয়ে গেলো। শ্রুতির মনের ভিতরে একটা ভয় জেঁকে বসে গেলো। শেফালী শ্রুতির কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে বললো, কিছু বলছিস না যে! শ্রুতি এক পাহাড় হতাশা নিয়ে বললো, বাড়ি চল।

শ্রুতির কাছ থেকে এই রকম হতাশাপূর্ণ উত্তর পেয়ে শেফালী বুঝে গেছে যে, তার কথাটা এভাবে বলা উচিৎ হয়নি। শ্রুতি আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পিছন পিছন আসছে শেফালী। 

শেফালী মনে মনে ভাবতে লাগলো, কাজটা সত্যিই ঠিক করনি সে! সেই ছোটবেলা থেকে সবাই শ্রুতিকে কালাচাঁদ নামটা নিয়ে ক্ষেপিয়েছে। শ্রুতি তখন হয়তো সেটাকে মজা হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটাকে ঠিক মজা হিসেবে মেনে নেওয়া যে কারোর পক্ষেই বেশ কঠিন। শেফালী মনে মনে ঠিক করে যে, পরে সে এর জন্য শ্রুতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে।

দূর মসজিদ থেকে মগ্রবের আজান ভেসে আসছে। শ্রুতি আর শেফালী বাড়িতে পৌঁছে গেলো। বাড়ির ছেলেরা সবাই নামাজে যাওয়ার জন্য ওজু করছে। কোথাও তেমন কাউকে দেখা গেলো না। শ্রুতি সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। আর দরজা বন্ধ করে দিলো। 

শেফালীও তার ঘরে গিয়ে পড়তে বসলো। তার বাবা আফসার আলী যদি তাকে সন্ধ্যার পর বই নিয়ে না দেখেন তাহলে একেবারে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে! 

শ্রুতিদের পরিবার একান্নবর্তী। সবাই একসাথেই থাকে। গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে দুইতলা একটা মাটির বাড়িতে শ্রুতিরা সবাই থাকে। শ্রুতির বাবা আফজাল আলী আর মা হলেন শাবনূর বেগম জ্যোতি। শ্রুতির ছোট চাচা আফসার আলী আর ছোট চাচি শেফা আক্তার। শ্রুতির দাদা-দাদি এখনো বেঁচে আছেন। তারাও শ্রুতিদের সাথে একসাথেই থাকেন। শ্রুতির দাদার নাম জাফর ইকবাল। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনি সরকারের পক্ষ থেকে এখনো টাকা পান। আর শ্রুতির দাদি হলেন জাহানারা বেগম। 

শ্রুতি নিজের ঘরে খাটের উপর হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। মুখ গুঁজে দিয়েছে ভাঁজ করা হাঁটুতে। শ্রুতির চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। 

চারপাশ নিঃশব্দ। ঘড়ির টিক টিক আওয়াজের সাথে সাথে শ্রুতির মনের ভয়টাও যেন বাড়তে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর শ্রুতির ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। সেই কড়া নাড়ার শব্দ কানে আসতেই শ্রুতির যেন শরীর থেকে রুহ বেরিয়ে যাবে এই রকম অবস্থা হয়ে যায়! শ্রুতি ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু দরজা খোলে না। দরজার বাহির থেকে আওয়াজ আসে,

শ্রুতি মা, দরজা খোল। আমি তোর মা। শ্রুতি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দরজা খুলে দেয়। আর সাথে সাথে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।

শাবনূর বেগম তার মেয়েকে ধরে ঘরের ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,

কি হয়েছে? আমি আছি না! শ্রুতি কিছুক্ষণ পর কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো, মা, আমি কিছুতেই ঐ লোকটার সাথে যাবো না। পাগলী মেয়ের কান্ড দেখ! এর জন্য কেঁদে ভাসানোর কি আছে! ওরা আজ শুধু তোকে দেখতে এসেছে। তোকে আমার কাছ থেকে কেউ নিয়ে যাবে না।

না। ওরা আমায় নিয়ে যাবে। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না মা। আচ্ছা, কোথাও যেতে হবে না। শুধু ওদের সামনে একটু বসবি। না। আমি কারো সামনে বসবো না। কিছুক্ষণেরই তো ব্যাপার! না।

দেখ মা, তুই কি আমার কথা শুনবি না? মা! তুমি অন্তত এভাবে বলো না। শাবনূর বেগমের জোরাজুরিতে শ্রুতি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। 

শাবনূর বেগম নিজ হাতে শ্রুতিকে সাজালেন। টকটকে লাল শাড়ি, চুলগুলো পিছনে খোঁপা করে বাঁধা। খোঁপাতে জুই ফুলের মালা। হালকা গহনা। হাত ভর্তি চুড়ি আর চোখে টানা করে কাজল। সব মিলিয়ে শ্রুতিকে দেখতে কোন অংশেই স্বর্গের পরীর থেকে খারাপ লাগছে না। সাজানো শেষ করে শাবনূর বেগম শ্রুতির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

চাঁদের টুকরো আমার শ্রুতি। কারো নজর যেন না লাগে! বাহিরে বসার ঘরে বাড়ির সবাই কয়েকজন অতিথির সাথে কথা বলছেন। সামনাসামনি দুইটা সোফার একটাতে অতিথিরা বসে আছেন। আর একটা ফাঁকা। বাড়ির অন্যরা বসেছেন চেয়ারে। 

কিছুক্ষণ পর শাবনূর বেগম শ্রুতিকে এনে অতিথিদের সামনের সোফায় বসিয়ে দেয়। লোকগুলোর সামনে বসে শ্রুতির খুব অসহ্য লাগছে। তার ইচ্ছে করছে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে! কিন্তু পারছে না। শ্রুতির দম বন্ধ হয়ে আসছে।

হঠাৎ কেউ একজন প্রশ্ন করলো, আচ্ছা মা, তোমার নাম কি?

শ্রুতি এরূপ কিছুর জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না। সে কিছুটা নার্ভাস ফিল করতে করতে আঁড়চোখে সামনের দিকে তাকালো। আর দেখার চেষ্টা করলো। সে দেখলো যে, চুল দাড়ি পাকা একটা লোক তাকে প্রশ্নটা করেছে। লোকটার বয়স তার দাদার বয়সের মতোই হবে!

শ্রুতি বিনয়ী কন্ঠে উত্তর দিলো, মাহিয়া আক্তার শ্রুতি।

শ্রুতির সামনের সোফায় তিনজন লোক বসে আছে। একজন এই বয়স্ক লোকটা যে তাকে প্রশ্ন করেছে। তার একপাশে তার বাবার বয়সী একটা লোক। আর অন্যপাশে তাকাতেই শ্রুতির মনের ভিতর ধুপ করে উঠলো।

একটা যুবক বয়সী ছেলে। সে এক দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে আছে। 

শ্রুতি ছেলেটাকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলো। ছেলেটার বয়স পঁচিশের বেশিই হবে! মাথার চুল কোঁকড়ানো। আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাটির চুলার মুখের মতো কুচকুচে কালো।

অতিথিরা সবাই শ্রুতির পরিবারের সবার সাথে কোন না কোন বিষয়ে কথা বলছে। কিন্তু সেই ছেলেটা কারো সাথে কোন কথা বলছে না। সে শুধু শ্রুতিকেই দেখে যাচ্ছে।

শ্রুতির মনের ধুপধুপানি আরো বেড়ে গেলো। এখন শ্রুতির নিঃশ্বাস নিতেও অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ শ্রুতির কানের মধ্যে যেন অদৃশ্যভাবে কেউ বলে গেলো,

এই কালো লোকটাই তোর স্বামী শ্রুতি। তোকে সারা জীবন এই কালো লোকটার সাথেই থাকতে হবে।কথাটা শোনামাত্রই শ্রুতির সারা শরীর কেঁপে উঠলো। 

Post a Comment

0 Comments